আগুনের মা নেই সংসারে,তাই ৮৯ বছর বয়স্ক দাদী ফয়জুন্নেছাই তার লালন পালন করেন। ৩ বছরের বাচ্চা আগুন। ফয়জুন্নেছা বৃদ্ধ মানুষ,দুই বছরের বাচ্চা আগুন কোন সময় কোথায় যায়, সঠিক ভাবে খেয়াল রাখতে পারে না। আগুন সবেমাত্র একটু একটু হাঁটে,তুতলিয়ে তুতলিয়ে কিছু কিছু কথা বলতে পারে।তাই ফয়জুন্নেছা সব সময় একটা ভয়ের মাঝে থাকেন, এই বুঝি কেউ এসে বলল: আগুন পানিতে পড়ে গেছে কিংবা আগুন, আগুনে পোড়েছে!
আগুন কখনো ঘরের সামনে মাটি দিয়ে খেলা করে, কখনো বাড়ীর সামনে। পেঠে যখন টান পরে, তখন ঘরে আসে দাদী কে বলে: “দাদু খাবাম,ভাত দৈ..। দাদী ভাত দেয়। কখনো যদি একটু দেরি হয়, আগুন চলে যায় তার পরশী চাচা হামিদের ঘরে। হামিদ দরিদ্র মানুষ । নুন আনতে পানতা ফুরাই। তার পরিবারের সদস্য অনেক। তাই যখন দেখে খাবার সময়, আগুন তার ঘরের দিকে আসছে, তখন হয়তো বিরক্তিই লাগে। হামিদের ছেলেরা যখন খেতে বসে, তাদের কাছে আগুন খাবারের জন্য হাত পাতে। হামিদ ছেলেদের কে বলে: “বেশি কইরা মইচ দিয়া দে, তাইলে আর চাইব না”। ছেলেরা বাবার কথা মত বেশি করে মরিচ দিয়ে আগুনকে ভাত দেয়।আগুন ঝালের কারণে চিৎকার করতে করতে দাদীর কাছে যায়। (আগুনদের আর্থিক অবস্থা একেবারে খারাপ না, মোটামুটি ভালই। অভাবের কারণে যে তার পরশী চাচার ঘরে গিয়ে হাত পাতে এমন নয়)।
আগুন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। এখন তার বয়স ৫ কিংবা ৬ বছর। ফয়জুন্নেছা তাকে প্রাইমারী স্কুলে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি করান। আগুন সহপাটিদের সাথে স্কুলে যায়। স্কুলে যাবার সময় ফয়জুন্নেছা তাকে টিফিন খাবার জন্য ২/৩ টাকা করে দেন। তা দিয়ে সে সহপাটিদের কে নিয়ে আইস্ক্রিম বা এটা ওটা খায়। আগুন সাথে থাকলে এটা ওটা খাওয়া যায়, এজন্যই সহপাটিরা আগুনের সাথে মিশে। ফয়জুন্নেছার দেয়া দুই/তিন টাকা আগুন তার বইয়ের ভেতরে রাখে। তার সহপাটিরা সুযোগ পেলেই তার টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। যে দিন আগুন বই খুলে টাকা না পায়, সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী আসে। চিৎকার করে দাদীকে বলে: “ট্যাহা দেম, আমার ট্যাহা কই?”
দাদী বলে: “ট্যাহা কই আমি কি কমু, তোর ট্যাহা কই আরাইছস আমি কি জানি?”আগুন দিনে দিনে বুঝতে পারে, তার সহপাটিরাই তার টাকা চুরি করে।তাই আগুন সহপাটিদের সাথে আর স্কুলে যায় না।
আগুন কে জোর করেও স্কুলে পাঠানো যায় না, চুপচপ বসে থাকে, কার সাথে কথা বলে না, কারো সাথে খেলতেও যায় না। সমবয়স্ক তার কাছে আনলে, সে তাদের সাথে করে ঝগড়া। আগুনের এসব আচরনের জন্য ফয়জুন্নেছাও চিন্তিত।
আগুনের বাবা আব্বাস গঞ্জের হাটে মদির দোকানদার। এক সময় তার স্বভাব ভালো ছিল না। আফিং এর নেশায় আসত্ত সহ নানা অকর্মে লিপ্ত ছিল। এর জন্য অবশ্য ফয়জুন্নেছা নিজেই দায়ী। আব্বাস ছোট থাকতেই তার বাবা মারা যায়। বাবা মারা যাবার পর আব্বাস কখন, কোথায়, কার সাথে মিশেছে খেয়াল ফয়জুন্নেছা রাখে নাই। আব্বাস তার অসৎ বন্ধুদের সাথে মিশে রাখাপ হয়ে গিয়েছিলো। ফয়জুন্নেছা ভেবে ছিলো ছেলেকে বিয়ে করালে, ছেলে হয়তো সংশোধন হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয় নাই।
আব্বাস নেশা করে বাড়ীতে এসে, আগুনের মা ফরিদাকে মারধর করতো। বলতো: “তোর বাপের বাত্তে ট্যাহা লয়া আই”।ফরিদা স্বামীর কথা মত অনেক বার বাবার বাড়ী থেকে টাকাও এনেছে। কিন্তু, ফলসূতি ভাল হয় নাই। বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনার পর্ও ফরিদার সংসার সুখের হয় নাই।অবশেষে আগুনের মামারা, ফরিদাকে বাড়ী নিয়ে গেছে। আগুনের মা যখন চলে যায়, তখন আগুনের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। ফরিদা আগুন সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তার ভাইদের কারনে আগুনকে পারে নাই। তার মামারা বলে: “অমানুষের বাচ্চা, অমানুষই অইব।এইডারে লগে রাইখা দরকার নাই”।
এসব পরিস্থিতির মাঝে আগুনের মায়েরও করার কিছু ছিলনা।
আব্বাস এই অনুসূচনায় পড়ে, এখন সব ছেড়েছে। ধরেছে ব্যবসা। গভীর রাতে বাড়ী ফিরলে, ফয়জুন্নেছা তার কাছে আগুনের বিষয়ে আলোচনা করে। বলে: “আগুনের মা রে লইয়া আয়, আমার এই বয়সে, আমি এইতা সামলাইতে পারতাম না”।
আব্বাস চুপ করে মায়ের কথা শুনে, কোনো জবাব দেয় না। কিছুদিন পর আব্বাস তার এক চাচাকে পাঠায় ফরিদাকে আনতে। কিন্তু, ফরিদা আর এ সংসারে আসবেনা বলে দেয়, আগুনের মামারা।
এর মাঝে কেটে যায় দুইটি বছর।আগুন কিছুটা অবাধ্য প্রকৃতির হয়েছে। তাকে যা বলা হয়, সে তার উলটো টা করে। ফয়জুন্নেছা আব্বাসকে আবার বিয়ে করার কথা বলে। আব্বাস প্রথমে রাজি না হলেও, পরে একমাত্র সন্তানের লালন পালনের কথা চিন্তা করে রাজি হয়। আব্বাস আবার বিয়ে করে। আগুনের ঘরে আছে সৎ মা। আব্বাস যে কথা চিন্তা করে বিয়ে করেছিলো, বাস্তবে তার বিপরীত হয়েছে। এরি মাঝে কেটে যায় আরো দুই বছর। আগুনের সৎমায়ের কোলজোরে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান।
এদিকে ফরিদাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে। ফরিদা রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে। তাদের পরিবারে , কন্যা রাজি কিংবা অরাজি তাতে কিছু আসে যায় না। ফরিদা ভাবে আগুনের কথা। কিন্তু, তার ভাইদের সামনে প্রকাশ করার কোন উপায় নাই। এক সময় ভাবে সবার অজান্তে, আগুন কে নিয়ে সে দূরে কোথাও চলে যাবে এবং তাই করে।
আগুনকে পাওয়া যাচ্ছে না! এর বাড়ী, ওর বাড়ী, আত্নীয়-স্বজনদের বাড়ী,সব জায়গা খোঁজা হয়। আব্বাস চিন্তা করে, ছেলে কোথায় যেতে পারে? নাকি তার মায়ের কাছে গেছে? খোঁজ নেয় ফরিদা কোথায়। খোঁজ নিয়ে দেখে ফরিদাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। আব্বাসের আর বুঝতে বাকি থাকেনা।
ফরিদা আগুনকে নিয়ে চলে গেছে, তার দূর সম্পর্কের এক চাচাতো বোনের কাছে। সে নারায়নগঞ্জে থাকে। ফরিদা সেলাইয়ের কাজ জানে, তার সাথে কথা হয়েছিলো, সেই কাজের ব্যবস্থা করে দিবে। ফরিদা তার চাচাতো বোনের বাসায় সেলাইয়ের কাজ করে, আর আগুনকে একটি স্কুলে ভর্তি করে।
এদিকে ফয়জুন্নেছা নাতীর জন্য কান্নাকাটি করে। আব্বাস একদিন কাউকে কিছু না বলে, আগুনকে খোঁজার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়।একদিন, এক সাপ্তাহ, এক মাস বাড়ি আসে না। পাড়ার লোকেরা বলাবলি করতে থাকে। আব্বাস ফরিদাকে নিয়ে পালাইছে। আগুনের সৎ মা এসব কথা শুনে, ঘরে যা আসবাব পত্র ছিল, সব ঢেলা করে বাবার বাড়ী চলে যায়। ফয়জুন্নেছা এর কারণ জানতে চাই, আগুনের সৎ মা বলে: “ এত্তা ঠিক করন লাগব, এর লাইগা লইয়া যাইতাছি”।
আব্বাস খোঁজে খোজেঁ, ফরিদা কাছে চলে যায়। আব্বাস যখন ফরিদার বাসায় গিয়ে উঠে তখন আগুন উঠনেই ছিল। বাবাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আচঁলের নিচে লোকাতে চায়। ফরিদা আব্বাস কে দেখে হতবাক। আব্বাস বলে: “আমি তোমরারে নিতাম আইছি, তোমরা চল”। ফরিদা অস্বীকৃতি জানায়। আব্বাস বলে: “আমি আগের সব কিছু চাইরা দিছি, আমি আর জীবনেও এমুন করতাম না।আমারে মাফ কর”। ফরিদা কোন কথা বলে না। ফরিদার চাচাতো বোন তখন বাসায় ছিলো না। ফরিদার চাচাতো বোন বাসায় আসে বিকালে । তখন আব্বাস তার কাছে সব বুঝিয়ে বলে।ফরিদার বোন বলে কয়ে ফরিদাকে রাজি করায়।
আব্বাস দুইদিন পর ফরিদা ও আগুনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে। বাড়ি ফিরে জানতে পারে, তার দ্বিতীয় বউ তাকে তালাক দিয়েছে। ফরিদাকে দেখে ফয়জুন্নেছা খুব খুশি হয়। ফয়জুন্নেছা বলে: “আল্লার কাম সবই ভালা”।
তের বছর পরঃ
আগুন এখন ২৩ বছরের যুবক, ভার্সিটিতে অনার্স ফাইনাল বর্ষের ছাত্র।আগুনের সৎবোনের গত বছর বিয়ে হয়েছে। ফয়জুন্নেছা এখনো জীবিত আছেন। তার বয়স একশত বার বছর। ফয়জোন্নেছার ইচ্ছা তিনি বেঁচে থাকতে আগুনকে বিয়ে করানো। নাতী বউ দেখে মরার খুব সখ…..